।। এ সংখ্যার কবি ।। আন্দালীব ।।










আন্দালীব এর কবিতা




o   পাতাল শহরের ম্যাপ

অরণ্যগহীন
এইখানে এলে বৃক্ষের নাম ভুলে যাই
ভুলি বায়ুবেগ, উত্তুঙ্গ জিরাফের হাড়
করতলে রাখি রত্নপাহাড়, ধুলোর জীবনী

কারা যেন ছিড়ে ফেলেছে আজ
পাতাল-শহরের ম্যাপ!
অবসন্ন পড়ে আছে ঘুমের সরণি।

কোজাগর চাঁদ জেগে আছে এইসব
বলিষ্ঠ বৃক্ষের পাশে 
জিরাফের উচ্চতা থেকে লাফিয়ে নামছে
ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার,
স্প্রিংয়ের রমণী।



o   নীলকুহকের বাড়ি

ঘনবিদ্যুৎ! এই পলকা ট্রিগার, কিছু দূর গেলে মিলবে সুনিশ্চিত
নীলকুহকের বাড়ি। দেখ মেঘের ফুলকি, অনেক বজ্রমাতাল গ্রাম
পেরিয়ে এসেছি আমি এই বনভূম। বাসুকির ছায়া পড়ে আছে দূর
সমুদ্রবিস্তারে। সহস্র বাতিঘর জ্বলেছে এইখানে, এই অনন্ত টানেল
আর নীল রঙ। সময়ের দাগ লেখা আছে সব রেডিওকার্বনে।
আজ এই রাতে অবগুণ্ঠনের ছল, আজ বিচূর্ণরেখা! কুহকের বাড়ি
হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ভ্রমে-বিভ্রমে।



o   হাওয়ালেখ

১.
নিরর্থের দিকে যাও। চিনে নাও, তোমার সমাধিতে কারা এসে
ঠুকে যায় হাওয়ার ফলক।

২.
ঘোর লাগে প্রপেলারে। কার গায়ে জেগে থাকে ওই মেরুন
রাত্রিবাস? দ্যাখো মানুষপুতুল, লৌহকারখানা থেকে উঠে আসে
কেমন সুগ্রীব বিমানের ঝাঁক! আমাদের আশ্চর্য অ্যারোড্রোমগুলো
ডানা ভাঙার আর্তনাদে ভরে ওঠে। মানুষ জেনে গেছে পতনের
শব্দ মূলত জাগতিক সংকেত এক পুনরায় জেগে ওঠার।
ফলে বাতাসের গান বাজে, তরঙ্গ লিখে রাখে আয়নোস্ফিয়ার।

৩.
ফুটেছে হাওয়ার ফুল। নীল আমব্রেলা। অসুখের দিকে রাত্রি
সরে গেছে। গ্রন্থ-মলাটের নিচে বয়ে গেছে রক্তাল্পতা।
আমরা তো দেখিনি আজও প্রসূন-সভ্যতা, আইসিস, দেখিনি
নতমুখী ফুল। গ্রন্থসরণির পাশে কী করে শুয়ে থাকে নশ্বরতা!
হায় মুদ্রারাক্ষসের দল, তোমাদের কাছে জমা রাখি আয়ুর ভ্রমর,
সুখ্যাতি, আত্মখুনের বারতা।

৪.
বৈধব্যে পুড়ে যাক মেঘ। হাওয়ার বারতা। তুমি প্রাচীন পুস্তক
নিয়ে কথা বল, যার ভাষা অস্পষ্ট। প্যাপিরাস হে, দিকে-দিকে
কার এত গোপন সংকেত আসে! বিদূষিকার লণ্ঠনে লেগে থাকে
নির্জ্ঞান, প্রবুদ্ধ  শহরের আলো। মহাচৈতন্যের মাঝখানে নিশ্চেতন
যেই দেবদারু গাছ আছে, অনুবাদে তারাও সক্ষম। তারা জানে
পৃথিবীর প্রাচীন পুস্তক সব মেলে ধরা আছে বিদূষিকার দিকে।
যার তৃতীয় নয়নে বিদ্ধ তীর। যার করপুটে অতীতের লিখনরীতি হাসে।

৫.
শেষমেষ গ্যাসোলিনই সত্য, গতিনির্ভর এই পৃথিবীতে আর
রাষ্ট্রনায়কেরা পিস্তলেরো। ফলে বুদ্ধি ব্যতীত আর হারাবার
কিছু নেই। আজ পৃথিবীর ম্যাপ নিয়ে মেতে আছে কারা?
উজবুক না কোন রাজর্ষী? কার নাম লেখা আছে গ্যালিলির
সমুদ্রতটে? সে সত্য সযতনে লুকিয়ে রাখে আজ লৌহ,
আকরিকের পাখি।




৬.
নেমে যাই ধীরে, এই অষ্পষ্ট গানের মাঝে। দেখি ফুটে আছে
ধূম্রস্বর, লহরী। গাগরি ছলকে ওঠে, গমকে-গমকে। ভাঙে ক্রম,
শ্রুতিবিশ্ব। পদপ্রান্তে নেমে আসে সমুদ্র-সোপান। অবরোহ গান
বাজে ইথারে-ইথারে, আজ গীত নির্যাস। পুষ্পরথ চেপে কারা  
চলে যায় দূরে? তারা জানে প্রস্থান আসলে হাওয়ার কারসাজি,
হাহাকার মূলত বনমর্মর।

৭.
উড়ে যাও ধ্বস্ত কাগজের প্লেন, এই বিজন ফরেস্ট, এই ব্যাকুল
সাব-আরবান দৃশ্য পেরিয়ে। যত দূর দেখ আজ চিৎপ্রকর্ষ,
শঙ্কার বিপরীতে জেগে থাকা রোদ। ছায়ার কাঠামো, বিটপ
আর ছিন্ন পত্রালী। কর্পূরের মত উবে যাওয়া উড্ডয়নপথ,
তারও তো বিয়োগচিহ্ন থাকে, যার দিকে চেয়ে ন্যুব্জ হয়
কাগজের প্লেন, তার ব্যথাতুর ডানা গুটিয়ে আসে।

৮.
কে থাকে আগুনপাহাড়ে - সেপ্রশ্নের মীমাংসা হয়নি আজও।
শুধু দূর দিকে চেয়ে মনোলিথখানি মৃদু হেসেছে। বাতাসে উড়েছে
ভলক্যানোর ছাই; ভস্মাধার পরিপূর্ণ হয়েছে। জেগে উঠেছে ধীরে
আকরিকের পাখি, যার আগুনে-ডানায় চেপে উভচরেরা মৃত্যুর
সীমানা পেরিয়েছে। অনতিদূরেই ধসে পরেছে পাথরের সেতু।
ফলে চির প্রশ্ন হয়ে দূরে আগুনপাহাড় শুধু দাঁড়িয়ে থেকেছে। 

৯.
ওঠো আজ, অনাবিষ্কারে চলো। স্তূপাকার পড়ে আছে যেখানে
জংধরা জাহাজের শব। উদগার শেষে ফিরে আসা যুদ্ধাস্ত্রের গায়ে
লেগে আছে আজও বহু যুদ্ধের তাপ, বহু স্খলনের চিহ্ন। আর যত
ওই ধাতব আকাশ, যতটা আলকালির সমুদ্র - তুমি লিখে রাখো
খাতায়, চিরকূটে; সেই সব মুছে যাবে। স্ফুলিঙ্গ রবে শুধু,  
অগ্নিকুণ্ড রবে। যত কামারশালার গান, হাপরের শব্দ চিরকাল
রয়ে যাবে হৃদয়ে আমার।

১০.
কিংখাবে রাখো প্রেম। বিরহ তোমার। আজ রণক্ষেত্রের দিকে
উড়ে যায় চূর্ণ চকিত গান যত; তারা জানে ধাতু-নিগ্রহ,
জানে হাপরের ছল কতোটা ধরে রাখে যুযুৎসা আমার।
যদি হননের রাত আসে, যদি ক্রূর হাসে আকরিকের ফলা;
তবে স্থানু হও, আর নতজানু হও। বৃশ্চিকসূর্যের নিচে
আজও কারা গান গায় এমন পেগান?

o   ব্রুনো

আমাদের মনে তখনও বর্তুল পৃথিবীর ধারণা জন্মায়নি।
ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রবোধের ফলে আমরা ভাবতাম, ওই যে
দূরের মাঠ; তার শেষে আকাশ এসে নেমেছে। সেখানে
একদিন নিশ্চয়ই পৌঁছনো যাবে। আমাদের স্কুলঘরগুলো
ছিল হেয়াঁলি মাখানো, বিভ্রান্তিকর। কুয়াশার মধ্যে মাথা
তুলে রাখা একেকটা ডুবোপাহাড়ের মতন। ধর্ম-শিক্ষকেরা
প্রিয় ছিল আমাদের, আর বিজ্ঞান শিক্ষকেরা মিথ্যেবাদী।
আমরা তাদের ছলগুলো এড়িয়ে চলতাম। তারা যখন
আমাদের ব্রুনোর কথা বলতেন; আমরা ভাবতাম এমন
পাগল ও প্রোপাগান্ডিস্টের পুড়ে মরাই ভাল। অথচ
আমাদের হৃদয় করুণায় আর্দ্র ছিল। আমরা ভাবতাম,
গ্যালিলিওর টেলিস্কোপে চোখ রাখলেই প্রভূ আমাদের
অন্ধ করে দেবেন। যদিও আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল প্রবল।
প্রতি সন্ধ্যায় উদভ্রান্ত বালকের মত আমরা পিতার সামনে
বসতাম। তিনি বলতেন প্রভূ সর্বজ্ঞ; আর তিনিই জানেন।
একটা কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে তিনি আমাদের পৃথিবী
দেখতে বলতেন। আর আমরা দেখতে পেতাম তারকারাজি,
সৌরঝড়, আমাদের তর্জনীর উপর সাঁইসাঁই পৃথিবীটা ঘুরছে।


o   অপুষ্পক - ৪

ফিরিয়ে নাও ফুল
এই মত্ত ঢালাইমেশিন যে' রকম
উগরায় ক্লিংকার
শ্রমঘন দুপুরের পাশে
এসে বসে মৃদু
বিকেলবেলার হাওয়া

চূর্ণ হীরক আর
ঘাসের জঙ্গল থেকে
অনাবৃষ্টির ছাট আসে
উদ্ধত বাবেলের চূড়া
থেকে দেখা যায়
অধঃপতনের দিকে সামান্য
এগিয়ে এসেছে ফুল


o   লংগরখানা - ১

বিপন্নতা এক রাষ্ট্রজনিত অসুখ। তারও আছে আমিষের লোভ।
শাসন, ত্রাসন, সর্বগ্রাস। গুম করে ফেলার ভালবাসা। সে তো
হায় বাঘবন্দি খেলছে সর্বত্র তোমার তরে, বুদ্ধিদীপ্ত হে সিটিজেন।
মৃদু উৎপীড়ন আর সহনীয় মাত্রার দুর্ভিক্ষ ঠেলে তোমার কাছে
অনিবার্য উঠে আসে ক্ষুধা। নবায়নযোগ্য, চিরমৌলিক। ফলে
তন্ত্র মানেই এক রাষ্ট্রচালিত মাৎস্যন্যায়। যেই ইকোসিস্টেমে আজ
এ খাচ্ছে ওকে, আর ও খাচ্ছে তোমায়। রাষ্ট্র ও নৈরাষ্ট্রের
পাকস্থলীতে পড়ে থাকছে হাহাকার, সুশাসনের অধঃক্ষেপ।


o   জাহাজডুবির পর

জাহাজডুবির পর আমাদের মনে পড়ে বিকল কম্পাস, সূর্যঘড়ি
আর পলিনেশীয় বালকের দিন। যাদের জানা ছিল এযাত্রা
পৌছোঁনো হবে না আর রুটিফলের দেশ, নারকেলবীথি,  
সোমত্ত নারীদের জঙ্ঘা! এযাত্রা অজস্র হীরক ফলবে আমাদের
বিমর্ষ জাহাজের পাশে। আর স্পর্শ হবে অসম্ভব। এইসব
দূরগামী নাবিকের আঙুল থেকে হারিয়ে যাবে স্পর্শদাগ, প্রণয়।
খালাসিরা হারাবে সোনালি মাউথ-অর্গ্যান, ব্যাঞ্জো। সমুদ্রের
অতিকায় মন্থন বলে, জাহাজডুবির কথা মাস্তুল জানে সব থেকে
আগে, তারপর আঁধার, সূর্যের অপ¯্রয়িমাণ আলো। সহনক্ষমতা
বস্তুত এক ঝিনুকেরই খোল; আর ভেসে থাকা মৃত্যূন্মুখ
জাহাজের চেয়ে ভাল।



o   অন্ধ ড্রিলমেশিনের মুখে

স্ফুরিত আফিমের বীজ
লেখা আছে প্রার্থনাগারের দেয়ালে-দেয়ালে
যাজকের পায়ুকাম তৃতীয় কিশোর
অতি সামান্যই ভালবাসে

দ্বিধার্ত ক্রসিংয়ে পড়ে আছে
সঘন ট্রাফিকের সারি,
আফিম আফিম

অন্ধ ড্রিলমেশিনের মুখে ফুটোগুলো যেন সব
ফুল হয়ে ফুটে আছে



o   পাড়ি

এমন ডিসেম্বরে রেতঃপাতের শোক জেগে ওঠে আমার।
হাওয়ায়-হাওয়ায় শাদা পৃষ্ঠাগুলো উড়ে যায়। অপরূপ
হয়ে উঠবার সমস্ত সম্ভাবনা ডিঙিয়ে বিষণ্নতায় যখন
ডুবে গিয়েছিল আমাদের বিবিধ পানপাত্রের হাতল,
দূর থেকে ভেসে আসছিল বিগত শিকারের দৃশ্যাবলি
আর চারিদিকের তামাম হনন।

আমার হননেচ্ছা হায়! তামাদি পড়ে আছে দিকচিহ্নহীন
কোথাকার কোন এক লোহার সিন্দুকে! আমি তো বস্তুত
শিশ্নহীন কামুক, শর-বিহীন এক তীরন্দাজের বোধকে
সাথে করে পেরিয়ে গিয়েছি এযাবৎকালের সকল তৃণভূমি।
আমার রেতঃপাতের শোক কাটে নাই তবু।

আমি কী সহজ হারিয়ে ফেলেছি যা ছিল আমার
সমস্ত কৌপীন, মেধার কলম, সবুজ-লেখার অফুরান কালি।
আমি প্রকৃতই হারিয়ে ফেলেছি সম্ভোগের তাবৎ কৌশল,
এমনকি ছল করবার যৎসামান্য পন্থা প্রকরণ সবি!



o   ট্রিগার হ্যাপি

এত কেন ঘোড়া দাবড়াচ্ছো হে তর্কবাগীশ? তোমার দিকেই
চেয়ে আছে যখন আগ্নেয়াস্ত্র সুন্দর! ওই টোটাবন্দুক হাতে
যারা শিকার করছে খরগোশ, ঘন-ঘন নিশানা পাল্টাচ্ছে;
তারা ছড়াচ্ছে কপট ত্রাস। স্যাংচুয়ারিতে নির্মম শুরু হচ্ছে
মৃগয়াপর্ব। কিছু দেখলেই লোকে বলছে - ফায়ার!









No comments:

Post a Comment