।। গদ্য ।। সোনালী চক্রবর্তী ।।





দেবারতি দি,

সদ্য ব্রাহ্ম মুহূর্ত ছুঁয়ে এসেছে এই গোলার্ধ , গড়িয়ার শীতলা মন্দির সংলগ্ন সেই ব্যাঙ্ক বাড়িটার দ্বিতলে এখনও দিনগত জাফরানি প্রণাম আঁকতে পারেনি সূর্য , সেখানে তুমি এখন একা......এখন ......একা ......
তোমার দিনলিপি বদলে গেছে অনেকটাই এখন , প্রথম পা রাখা মাত্রেই যে অ্যাপার্টমেন্টের আভিজাত্য কোনও তারকা চিহ্নের তোয়াক্কা না করেই শ্রদ্ধায় অবনত করতো অগণিত কাব্য সাধককে তার গ্রন্থরাজির বিপুল ঐশ্বর্যে , তার সম্রাট প্রয়াত হয়েছেন সদ্যই । শুধুমাত্র শয়নযোগ্য পরিসরটুকু ছাড়া যে শয্যায় বইয়ের সমাহার ,তার অধিপতি সুদীর্ঘ কিংবদন্তী জীবনের পারে যাত্রা করেছেন অজ্ঞাত রাজ্যে । এই নশ্বরতায় আমরা আর তাঁকে তাঁর কাঠের আসনটিতে , নিঃসীম ধৈর্যে , কোনওদিন পাবোনা অজস্র তরুন ও পুরাতনের সাধনশ্রোতার ভূমিকায় । আমার প্রশ্ন ঠিক এইখানেই । তুমি তো অন্তঃপুরচারিণী ছিলে না , সাধারন জীবন চর্যার বৃত্তে থেকে খুঁটিনাটি গৃহস্থালি , ব্যাঙ্ক , বাজার , সব দিক সব ভুজে ঠেকিয়ে তুমিও তো সৃষ্টির এক বিরল দিগন্তেই অবস্থান করতে, তোমাকেও তো একাকী আলোচনায় পেতে চেয়েছে , পেয়েছেও কত কাব্যানুরাগী , অথচ তারাও পেয়েছে যারা শুধুমাত্র  মনীন্দ্র গুপ্তের সাক্ষাৎকার নিতে গেছে ,তাঁর ছবি ,তাঁর লেখা , দু দণ্ডের আলাপচারিতা । আমি সম্ভবত আমার প্রশ্নকে ব্যাখ্যায়িত করতে পারলাম । হৃদয়ের কোন ঘোর থেকে এই প্রশ্ন এলো ,জানিনা । কিন্তু মনে হল , প্রশ্ন করি , সেইসব মুহূর্তেও কি তুমি একা হতে চাওনি ? 

কোনও ক্ষেত্রই ব্যাতিক্রম না হলেও আমি শুধু সাহিত্যকেই মাত্রা ধরেছি এই কথনের , সুতরাং বলি , ব্যাক্তি স্বাতন্ত্রে স্বয়ং ইতিহাসের দাবীদার দুই স্বত্বা যখন বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন আর যুগ্ম যাপনে অতিক্রম করে চলেন দীর্ঘ ,  দীর্ঘ পথ ,আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছা হয় , নারী অংশ তার কবি স্বত্বার নিরিখে ক্রমশ একা হয়ে কি পড়েনা শুরু থেকেই ? তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারো, ৮ ই মার্চ সংক্রান্ত কোনও প্রবন্ধ রচনার তাগিদে আমার এই জিজ্ঞাসা নয়অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে হলেও যে নিবিড় বুনট তোমার আর আমার মধ্যে এসেছিলো ২০১৬ সালের কয়েক টি অগাস্ট দুপুরে , তাকে আর যাই হোক, সাধারন বেসাতির মূলধন করা যায়না , এ তুমি জানো ... তখন তুমি একা ছিলে না । 


আমার ভিতরে এই প্রশ্নের বীজ প্রথম বুনেছিলেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কবি সুহৃদ সহিদুল্লাহ, যখন ১০০ তম 'বাক' এর বিভাগীয় সম্পাদক হিসাবে আমি সেই বিশেষ সংখ্যাটির 'নির্বাচিত কবি' হিসাবে তোমাদের দুই জনকে একত্রে চেয়েছিলাম , বিধাতা সুপ্রসন্ন হওয়ায় , পেয়েওছিলাম । সেই সূত্রেই প্রথমে দূরভাষ , সাক্ষাৎ আর আজকের এই দ্বন্দেরাআমায় উনি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন , যৌথ প্রস্তাবনায় যে কোনও আঙ্গিকেই দুই জনের প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপিত হয়না যদি তারা বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ থাকেন । উদাহরন হিসাবে মনীন্দ্র গুপ্ত এবং দেবারতি মিত্রের কথা এসেছিলআমরা যারা নারীবাদের মিছিল করি , বিন্দুমাত্র ঋণাত্মক না হয়েও নিজের পদবীতেই সারা জীবন পরিচিত থাকার যে মধুর দৃঢ়তা তুমি দিয়ে গেলে, তাকে যেন উপেক্ষা না করি । আজ যখন ফেসবুকে দেখি  'মণীন্দ্র গুপ্ত সংখ্যা' এর উদ্বোধক তুমি , বই হাতে তোমার ছবি, আমার প্রশ্ন প্রবল হয় । সদ্য প্রয়াত কবিপত্নির স্ত্রীয়ের ভূমিকায় আমি এক কবি স্বত্বার একাকীত্ব প্রার্থনা করি , ব্যাক্তিগত নির্জনতা দাবী করি সেই কবির, যিনি স্ত্রী নন । অনধিকার চর্চা করছি ? করছি তো সেই মানুষ টিকেই যিনি , আমি একা একটি মেয়ে , এতোটা রাস্তা একা গাড়িতে পেরোচ্ছি শুধু তাদের কাছেই পৌঁছানোর জন্য জেনে না খেয়ে দুপুর অবধি বসে থাকেন , অজানা ,অনাত্মীয় তাকে উৎকণ্ঠায় ফোন করে খবর নেন বারংবার , কতদূর পৌঁছলাম , বাড়ির সামনে চেনা শুভানুধ্যায়ীকে খোঁজ নিয়ে দেখতে দাঁড় করিয়ে রাখেন পথ ভুলে যাতে বাড়ি পেরিয়ে না যাই নিশ্চিন্ত হতে , শুধুমাত্র কথা দিয়েছেন বলে শারীরিক অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য করে নতুন লেখা দেন প্রগাঢ় সৌজন্য বোধে , মিষ্টি খাইনা বলে আমেরিকান সিন্থল ব্যাগে পুরে দেন আর শিশুর সারল্যে বারবার বলেন "তুমি এত ছোট ? এতো ? জানলে আমি আরও চিন্তা করতুম এখনও পৌঁছালে না বলে " , এই আসমানি উদারতাকে আমি অকপটে আমার প্রশ্ন জানাতেই পারি, ক্ষমা চাইতে পারি তা ভুল হলেও । যার ইচ্ছায় আমি আমার প্রিয় লেখাদের পাঠ করে শুনিয়েছি আর পুরস্কার পেয়েছি অগাধ আশীর্বাদ , আজ নিজের ভিতরে আসা ঢেউ কে অন্যায় তট ছুঁতে জেনে আরেকবার নতজানু হতে পারবোনা কি সেদিনের প্রণামের ভঙ্গিমায় ? কিন্তু জানতে তো হবে আগে তা অনুচিত আদৌ কিনা ? মণী্ন্দ্র গুপ্তকে আমি স্যার ডেকেছি আপনি সম্বোধনে আর তোমাকে দিদি , তুমি কতই না হেসেছ সেই নিয়ে, নাহয় সেই হেসেই আরেকবার উত্তর দিও । 


স্থূলাঙ্গী তুমি কোনোদিনই ছিলেনা ,  যাদবপুরে যখন মেধাবী ছাত্রীর ভূমিকায় , সেই সময়ের লাবণ্যময়ী কালচক্রে কৃশাঙ্গী হয়েছে কিন্তু দুটি চোখের তীব্র ঔজ্জ্বল্য দিন দিন উজ্জ্বলতরই হয়েছে । স্যার চলে যাওয়ার পর তোমায় কোনও সৌজন্য ফোন আমি করে উঠতে পারিনি ,তার এক কারণ ভদ্রতার আচার পালনে আমার চিরকালীন অপারগতা, অপর কারন অবশ্যই আমি কবি দেবারতি মিত্রকে অন্তত আমার দিক থেকে বিব্রত করতে চাইনি বলেই । তোমারও নিশ্চয়ই ছিল নিজস্ব শোকানুভুতি এবং তা নিজস্বতায় প্রকাশের অধিকার , এক কবির প্রতি আরেক কবির , দীর্ঘ দিনের সহচরির , অথচ তুমি তা পেয়েছ কি ? একা হতে চাওনি কি কবি মণী্ন্দ্র গুপ্তের স্ত্রীর তরফে যাবতীয় শোকপ্রস্তাব গ্রহন ও ধারন করাকালীন ? আমার এই সব কূট সন্দেহরাই কি আমার চোখে তোমার সাম্প্রতিকতম ছবিটিতে তোমায় এতো ক্লান্ত দেখাল ? ক্ষমা প্রার্থনীয় । 

এই যে আমি, তোমারই প্রশ্রয়ে এতো দূর ধৃষ্টতা অর্জন করেছি যে, প্রকাশ্য চিঠিতে তোমায় প্রশ্ন রাখছি তোমার একাকীত্ব প্রসঙ্গে, সেই আমি কি পারলাম অন্তত এই স্থান টুকুতে তোমার অস্তিত্বকে একক রাখতে ? বারংবার দ্বৈতই তো করে চললাম । কবি মাত্রেই তো একাকী , বড় একাকী , সংবিধান যদি মৌলিকতাকে স্বীকৃতি দেয় তবে কাব্য বিধিতে অলিখিত অধিকার মুদ্রিত আছে চিরকাল কবিসত্ত্বার স্বাতন্ত্রের । কবিতা লিখলেই তো কবি হওয়া যায়না । কবিজন্ম বিরল এক ঘটনা এই পৃথিবীর বুকে , আর তাই যারা প্রকৃত  কবি ,তাদের নিয়ে বড় স্পর্শকাতর হয়ে পড়ি বিচিত্র চিন্তায় । আমি কবি দেবারতি মিত্রকে নিয়ে চিন্তিত । ভাল থেকো কবি । 

                                             সোনালী ,
                         প্রযত্নে , ' কৃষ্ণনগরের ছোট মেয়েটি '


No comments:

Post a Comment