৬
বাংলা এমন এক ভাষা যে ভাষাকে তার অধিকার রক্ষার
প্রয়োজনে বারবার অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
উর্দুর আগ্রাসন থেকে, অহমিয়াদের আগ্রাসন
থেকে এবং হিন্দীর আগ্রাসন থেকে নিজের স্বতন্ত্রতাকে মর্যাদাকে রক্ষা করার জন্য লড়াই
করতে হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলা ভাষার
গরিমা ঠিক এখানেই। তাঁর সংগ্রামের ইতিহাস তাঁর
অস্তিত্বের ইতিহাসের পাশাপাশি তার ধারাবাহিক
মর্যাদা রক্ষার যে নিরন্তর রক্তলাঞ্ছিত দিনলিপি তাও আমাদের মহিমান্বিত করে।
ভাষাকে সজীব রাখে মানুষ । ট্রেডমার্কা বাণিজ্যিক কাগজগুলি এই
আবেগের মূল্য বোঝে না। ভাষা তাদের
কাছে বাণিজ্যের পসরা। শুধু হিন্দি, উর্দু বা অহমিয়া নয়। বাংলা ভাষা বেঁচে থাকে এবং আরও নিরন্তর গতিশীল হয়ে ওঠে এই বাণিজ্যিক আগ্রাসনের
বিরুদ্ধে যে ধারাবাহিক লড়াই চলছে প্রতিনিয়ত তারই সক্রিয় দাপটে ।
কথাগুলো বাবা বুঝেছিলেন একেবারে কৈশোরেই ।
তাই তাঁর লেখালেখির মধ্যে রয়ে গেছে পুরুলিয়ার এক নিজস্ব নির্মল গন্ধ। খরায় ধুড়সা পড়া মাটির ভেতর থেকে যে গন্ধ বেরোয়
সেরকম। ধুলা গরম হলে যে ভাপ বেরোয় , সেরকমই এক প্রতিবাদের উত্তাপের।
পড়াশোনায় প্রথমদিকে অত্যন্ত মনযোগী থাকলেও ধীরে
ধীরে বিদ্যালয়মুখি পড়াশোনা
থেকে সরে যাচ্ছিল মন। আমার জেঠুমনি ত্রিবেনীপ্রসাদ
গঙ্গোপাধ্যায় এবং শিবপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় মণিহারা স্কুলের কৃতি ছাত্র।
প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে তাঁরা তখন বিষ্ণুপুর রামানন্দ
কলেজে ভর্তি হয়েছেন । ঘরে তখন তেমন
পয়সা নেই। জমিতে অল্পস্বল্প ধান যা হয়
তা দিয়ে সারাবছরের খাবারের সংস্থান কোন রকমে হয়।
সঞ্চয়ের তেমন সুযোগ নেই।
টিউশনিতেও দাদুর তেমন আয় হয় না।
গ্রামের মানুষের হাতে পয়সাই বা তখন কোথায় ।
বেশির ভাগই দুঃস্থ আদিবাসী ছাত্র। এর মধ্যে প্রথমবার ম্যাট্রিক উত্তীর্ণ
হতে পারেনি বাবা । দুটো বিষয়ে সামান্য কিছু নম্বরের
জন্য আটকে গেছে ।ব্যঙ্গ বিদ্রূপের শাণিত তিরগুলি আরও ধারালো হয়ে
উঠেছে চারপাশে , যারা হিন্দি ভাষা নিয়ে ভক্তিতে গদগদ
। তারা এতদিনে মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে গেছে। সেই সুযোগ ছাড়বেই বা কেন - “
কবিতা লিখলে এরকম তো হবেই। রবি ঠাকুরের সেকন্ড এডিশন। আগে পড়াশোনা করো মন
দিয়ে , তারপর
কবিতা, আন্দোলন ।“
দ্বিতীয়বার পরীক্ষার জন্য তেমন প্রস্তুতিও হচ্ছে না।
টিউশনের বালাই নেই।
পড়াতেও তেমন আগ্রহ হচ্ছেনা ।
মনে হয় সিলেবাস যেন বেঁধে দিতে চায় কিশোরের চঞ্চল পা ।তার ইচ্ছে অনিচ্ছে ভালো লাগা মন্দ লাগার
এখানে যেন কোন দাম নেই। জেলার ইতিহাসই
যারা জানে না তার মুঘল আমলের ইতিহাস পড়ে গাদা গাদা নম্বর পাচ্ছে।
এতে কি আদৌ কোন লাভ হয়।
দাদুকে এখন একটু চঞ্চল দেখায় ।
সাত পাঁচ ভাবনাচিন্তা তাঁর মধ্যেও ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে থাকে
। তিন তিনটে মেয়ে বড় হচ্ছে।
তাদের কথাও ভাবতে হয়।
এর মধ্যে ইতিবাচক খবর বলতে ১৯৫৬ সালের ২০ শে এপ্রিল পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে ১০২৫ জন ভাষা সেনানী কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেন ।এই ঘটনায় নতুন করে উৎসাহ ফিরে আসে মানুষের।
টগবগ করে ফুটতে থাকে আবেগ।
হয় এসপার নয় ওসপার।
একটা কিছু করতেই হবে।
বাঁকুড়া বেলিয়াতোড় সোনামুখি
পাত্রসায়ের খন্ডঘোষ বর্ধমান পান্ডুয়া মগরা চুঁচুড়া চন্দননগর হাওড়া হয়ে কলকাতা শহরের দিকে শান্তিপুর্ণ
পদযাত্রা চলতে থাকে। রাস্তার পাশে অসংখ্য মানুষের উষ্ণ অভিনন্দনে তাঁরা বুঝতে পারে অসংখ্য মানুষের
হাত তাদের ধরে আছে উষ্ণতায় । ভালোবাসায় । ৬ মে এই শান্তিপূর্ণ মিছিলটি কলকাতা পৌঁছায় ।
তাঁদের দাবি ছিল সমগ্র মানভুমকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত
করতে হবে। সেই দাবিকে সামনে রেখে ধর্মতলায়
আইন অমান্য হয়।
এই পদযাত্রার পর ৬ মে আইন অমান্য করে ৯৬৫ জন কারাবরন করেন ।
তার কয়েকদিন আগেই
৪ মে উভয় রাজ্যের সংযুক্তির প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
তবু চাপ থেমে থাকে না । লড়াই থমকে যায় না। মানুষের মনে
আগুনের মতো ধিক ধিক করে জ্বলতেই থাকে দিনরাত। জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালের ১৭ আগস্ট বাংলা বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিলটি লোকসভায় পাশ হয়
এবং কিছুদিন পর ২৮ শে আগস্ট তা রাজ্যসভাতেও তা পাশ হয়ে যায়।
১লা সেপ্টেম্বর এতে রাষ্ট্রপতি সই করেন ।
এর ফলে ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর
২৪০৭ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ১১৬৯০৯৭জন লোক সংখ্যা নিয়ে পুরুলিয়ার
বংভুক্তি ঘটে । ধানবাদ মহকুমা বিহারের মধ্যে থেকে যায়।
হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেসমস্ত শিক্ষক চাকরি হারিয়েছিলেন।
যেসব মানুষ অত্যাচারিত হয়েছিলেন। কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।শুধু তাই নয় যারা সরাসরি ভাবে
না হলেও যারা পরোক্ষভাবে নিপীড়িত হয়েছিলেন, অপমানিত হয়েছিলেন। এই দিনটিতে তাঁরা সবাই
পেয়েছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দ। ভাষার
স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতার চেয়ে গৌরবের আর কি হতে পারে? বেদনা হয় আজও যখন ইতিহাসের পাতায় অবহেলিত থেকে
যায় এই বিষয়টি। এমনকি পুরুলিয়ারও অনেকে জানেনা এই ইতিহাস। তখন মনে হয় আমরা কোন ইতিহাস
পড়ি । সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস? লুপ্ত
অস্তিত্বের উপাদানগুলোকে সত্যিই কি জীবন্ত
করে তোলে কেউ ? নাকি তা ঢাকা পড়ে যায় হিমগর্ভে ?
পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি তো হল। এবার কি হবে ?
যারা নির্যাতিত হয়েছিলেন তাঁরা কি সম্মানিত হবেন? না কি আরও দীর্ঘ অপেক্ষা।
( চলবে)
( চলবে)
মনে হচ্ছে এই লেখাটি আগে কেন লেখা হয় নি । আর একটু বেশি পরিসর দেওয়া গেলে ভালো লাগত ।
ReplyDelete