।। ‘বাক্ ১২১’ এসে পড়ল। এই সংখ্যা থেকে শুরু হল একটি
নতুন বিভাগ- ‘বাজে কবিতা’। বাজে
কবিতা অর্থাৎ খারাপ কবিতা নয়। কবিতার ভালো বা খারাপ হয় না। কবিতা হয়, অথবা কবিতা হয় না, এই উক্তিও অতিসরলিকরণ। কবিতা কী
সেটা যেহেতু কেউ বলতে পারে না, কোন লেখা কবিতা হয়েছে,
কোনটা হয়নি, এটাও কেউ বলতে পারে না। যে লোকটার
ফাঁসি হল, সে সত্যিই খুনটা করেছিল কিনা, ফাঁসির দড়ি পরীক্ষা করে বলা যায় না।
কবিতা
কী, সেটা আগে নির্ধারিত হোক। সম্ভবত সেটা কোনোদিন হবে না। ‘বাজে কবিতা’ অর্থে আপনারা কবি হরিচরণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্য নিতে পারেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, অভিধানও যে কবিতা হয়, সেটা
তিনি দেখিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন যা কিছুই অপ্রাসঙ্গিক, অনির্দিষ্ট, আকস্মিক, অসার,
অমূলক ও অনাবশ্যক- তাকেই আমরা ‘বাজে’ বলতে পারি। যেকোনো কবিতাই শেষ অবধি এই শব্দগুলোকে আলিঙ্গন করে। আজ অবধি
একটিও ‘কাজের কবিতা’, ‘প্রাসঙ্গিক
নির্দিষ্ট আবশ্যক কবিতা’-র দেখা মানবসভ্যতা পায়নি। দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ অথবা শেকসপীয়ারের সনেট অথবা গ্যেটে বা
রবীন্দ্রনাথ যাঁর লেখা কবিতাই হোক না কেন, শেষ অবধি ওয়েস্ট
পেপার বাস্কেট থেকে সুকৌশলে পালিয়ে আসা লিখিত একটা ব্যাপার ছাড়া একটা কবিতা কিছুই
নয়। যেহেতু ‘বাজে’ শব্দটা হরিচরণের
মতানুসারে ‘তাছাড়া’ ও ‘তদ্ভিন্ন’-কেও শনাক্ত করে, আমরা
‘অন্যরকম’ অর্থেও ‘বাজে’ বলতে পারি।
‘বাজে কবিতা’-এ কোনো অপটুতা বা বানান-ব্যাকরণের
ত্রুটি নিয়ে আস্ফালন নেই। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নামক বিশ-শতকীয় মূর্খতার সঙ্গে ‘বাজে
কবিতা’-র কোনো যোগ নেই। কবি শিক্ষিত হলে আলাদা কোনো খাতির পাবেন না, অশিক্ষিত হলেও
কোনো কোটা বা সুবিধা মিলবে না তাঁর। অক্ষর পরিচয় না থাকলে কবি হওয়া অবশ্যই যায়,
কিন্তু কবিতা লেখা যায় না। এদিক থেকে এটা অস্বীকার করে লাভ নেই, অক্ষরের সঙ্গে যে
কবির যত পরিচয়, তিনি কবিতা-লিখন প্রক্রিয়ার প্রতি তত সুবিচার করতে পারবেন। সেটা
ইস্কুল-কলেজের অক্ষর-পরিচয় নয়, বলা বাহুল্য। প্রথাগত শিক্ষার দিক থেকে আমি নিজেও
অনেকটাই অশিক্ষিত, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে সরকারিভাবে আমি বাংলা শিখিনি, এবং ভাগ্যিস!
‘বাজে
কবিতা’ তিনিই লিখবেন যাঁর মধ্যে কবিতা ‘বাজে’, অর্থাৎ বেজে ওঠে। দেখা যাক, এই ভাবনা নিয়ে কতদূর
যেতে পারি আমরা। এই সংখ্যায় সূচনা হল মাত্র। বাংলা কবিতার বারোটা বেজে গেছে বলছেন? ক্ষতি কী? মাথার উপর লম্বা রোদ পড়বে, ক্ষতি কী?
দোকান
থেকে কেনা গোলাপ তো সবাই উপহার দিতে পারে। সম্ভব হলে গোলাপের একটা গাছ লাগান। ফুল
ফোটান। তারপর তার ফুল উপহার দিন। অবিশ্যি তখন হয়ত আপনার আর সেই ফুল ছিঁড়তে ইচ্ছে
করবে না।
কাউকে
কাউকে বলতে শুনি তিনি সব রকমের কবিতা লিখতে পারেন। তিনি নাকি বিশেষ রকমের কবিতা
লেখায় বিশ্বাস করেন না। এটা বলে তিনি হয়ত নিজেকে খুব খোলা আকাশের পাখি বোঝাতে চান।
কিন্তু আমার হাসি পায়। যার নিজস্ব ডানা
নেই সে উড়বে কী করে, আকাশ যতই খোলা হোক? তিনি কি বলতে চান, তিনি
শ্রীজাতর মতো লিখতে পারেন, আবার অরুণ মিত্রর মতোও? শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো লিখতে পারেন, আবার ভাস্কর
চক্রবর্তীর মতোও? এই ‘সব রকম’ জিনিসটা কী? একজনের কবিতা পড়ে যদি বোঝাই না যায়
সেটা তিনি লিখেছেন, তাহলে তাঁর লেখার কারণ কী? নাম করা? বাংলা কবিতার সার্বিক সেবা করা? প্রথম উত্তরটাকে সন্দেহ করি না। অবহেলা করি। দ্বিতীয়টাকে অগ্রাহ্য করি।
আমরা বাজনা শুনে বলে দিই সেটা আমজাদ আলি খাঁ বাজাচ্ছেন না পাড়ার সিধু। সিনেমার
একটা ফ্রেম দেখলে বোঝা যায়, সেটা সত্যজিতের নাকি তরুণ মজুমদারের। সেটাই
সিগনেচার। একজন কবি আর কিছু নন, তাঁর সিগনেচার ছাড়া। সকল
প্রভাব, সকল লেনদেন যেখানে ফুরোয়, সেখানে
কবির সিগনেচার থাকে। নিজস্বতা। দলিল জাল
করলেও ধরা পড়ে যেতে হয় সেখানেই।
দা
ভিঞ্চি তাঁর ছবিতে সই করতেন না, কিন্তু তুলির টান দেখে এই ৫০০
বছর পরেও এক্সপার্টরা বলে দিচ্ছেন কোনটা তাঁর আসল ছবি, আর
কোনটা ফেক।।
আর্জেন্টিনার
বিখ্যাত কবি ও লেখক হর্হে লুই বর্হেস অন্ধ হয়ে
গিয়েছিলেন। তিনি ট্রেনে যাচ্ছিলেন একটা গোয়েন্দা উপন্যাস পড়তে পড়তে। চোখের সমস্যায়
আগে থেকেই ভুগছিলেন। ট্রেন একটা টানেলে ঢুকল, যখন বেরিয়ে এল, বর্হেস অন্ধ হয়ে গেছেন বাকি জীবনের জন্য। বর্হেস পরে বলেছিলেন অন্ধদের জীবনে কোনো অন্ধকার থাকে
না। চোখের সামনে হলুদ,
কমলা, লাল, সবুজ
ইত্যাদি মেশানো একটা গাঢ় কুয়াশা আটকে থাকে, সেটাকে ছাড়িয়ে চোখ বেরোতে পারে না।
অন্ধদের জীবনে কোনো কালো রঙ নেই। কিন্তু, যদি ভাবি, শুধু অন্ধরা
কেন? আমরা
যারা লিখি, আমরা
যারা চিত্রশিল্পী, আমরা
যারা এই পৃথিবীটাকে দু চোখ মেলে দেখতে খুব ভালোবাসি, আমাদের সকলের
চোখের সামনেই ওই কুয়াশা কি অল্প-বিস্তর নেই? আমরা হয়ত ওটাকে টের পাওয়ার মতোও দৃষ্টি রাখি না। বর্হেস
তাঁর চোখ হারিয়ে সেটা টের পেলেন, চোখের আলোয় পেলেন চোখের বাহিরকে। এসব ভাবের কথা। জটিল
কচকচি। মোক্ষম প্রশ্নটা হল, সেই ডিটেকটিভ উপন্যাসটা কি বর্হেস
শেষ করতে পেরেছিলেন? উল্লেখ নেই। তবে বর্হেসের স্ত্রী ভার নিয়েছিলেন বই পড়ে
শোনানোর, লেখার
ডিকটেশন নেওয়ার। অন্ধ বর্হেসের চাকরি ছিল এক গ্রন্থাগারে, এটাও উল্লেখযোগ্য। সেই গ্রন্থাগার নিশ্চয়ই অন্ধ বর্হেসের
চোখে অসংখ্য বইয়ের সমাধিক্ষেত্র ছিল না।।
অনুপম
মুখোপাধ্যায়
পরিচালক : ‘বাক্’