।। তপোভাগ ।। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় ।।





প্রথম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন

দুই : পৃথা


ত্রিভূমক এই শ্বেতাবাসটি রাজভবনের তুলনায় অশ্বনদীর অধিক নিকটে
নৃপতি ভোজরাজ এই শ্বেতভবনটি নির্মাণ করিয়েছেন অতি তৎপরতার সঙ্গে, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এই ভবন গড়ে উঠলো পৃথার চোখের সামনে নৃপতি স্বয়ং যে ভবনে পরিচরবর্গ নিয়ে থাকেন, তারই সংলগ্ন উদ্যানে এ ভবন, অথচ নৃপতির নিজের বাসভবন কেবল একভূমক না জানি কে সে মহাত্মা, যাঁর জন্য নির্মিত হয়েছে এই ভবন নৃপতি স্বয়ং এই ভবনে পদার্পণ করেননি এখনো, সেই তপস্বী এলে হোমাদি সম্পন্ন হলে তবে তিনি প্রবেশ করবেন এখানে অন্যদেরও এখানে প্রবেশ নিষেধ, পৃথাকে নিষেধ করার কোন প্রশ্নই নেই, পৃথাই সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে এ ভবন সজ্জিত করেছে ও করছে কুড্যের স্থানে স্থানে দীপাধার রাখবার অলিন্দ প্রস্তূত করিয়েছে সে, যজ্ঞবেদী বিশেষ যত্নসহকারে প্রস্তূত করা হয়েছিলো, অধিক কোন আড়ম্বরও আবার করা সমস্যার, তপস্বীটি কোপন স্বভাব, কখন কি কারণে যে অভিশাপ উদ্যত হয়ে উঠবে তাঁর, তা নিয়ে নাকি দেবতারাও সন্ত্রস্ত থাকেন এই গৃহের গঠনপ্রণালী কি প্রকার হবে, তা স্থির করার সময় প্রতিবার পৃথাকে সঙ্গে রেখেছিলেন নৃপতি কুন্তীভোজ একাধিক স্থপতিও ছিলেন, যজ্ঞবেদীর কেমন কি হবে তার সিদ্ধান্তের জন্য সকলেই, অদ্ভূতভাবে এক শ্যামবর্ণ ব্যক্তির প্রতি জিজ্ঞাসু হয়েছিলো বিস্মিত পৃথা লক্ষ্য করেছিলো, সকলে বিনা প্রশ্নে এ নির্মাণে যার ওপর নির্ভর করছেন ও যাকে মাথা বলে মেনে নিচ্ছেন, তিনি কৃষ্ণবর্ণ মধ্যমকায় মধ্যবয়স্ক নিষ্প্রভ ধরনের দর্শণধারী পুরুষ, বস্ত্রাবরণ মলিন তাঁর, চোখেমুখে ক্লান্তি ও নিরাশার ছাপ জানা গেছে তিনি অরণ্যচারী, গোষ্ঠীপরিবার নিয়ে অরণ্যে বাস করেন যজ্ঞবেদী সংক্রান্ত জটিল গাণিতিক হিসাব তিনি ছাড়া আর কেউ পারবেন না, সমগ্র ভবনটির নির্মাণকৌশলই বা কীরূপ হবে, সে সিদ্ধান্তও তাঁরই আপাৎকালীন পরিস্থিতিতে কুন্তীভোজ তাঁর অরণ্যাবাসে গিয়ে বিনম্র অনুনয়ে তাঁকে সন্মত করে এই ভবন নির্মাণের জন্য নিয়ে এসেছেন জানা গেল, তাঁর নাম - ময়

 এই ভবনের শীর্ষে সমতল ছাদটি পৃথার বড়োই পছন্দের
ছাদটিতে পরিধি ব্যেপে প্রাচীর, সে প্রাচীরের উচ্চতা পৃথার দেহের উচ্চতার সমান প্রথম যেদিন সে এই ছাদে উঠেছিলো, তখন ছিলো অপরাহ্ন, দিনপ্রকাশ সূর্য তখন অরুণবর্ণ ধারণ করছেন, পশ্চিম নভোমণ্ডলে লাল মেঘ যেন অন্যজন্মের স্মৃতির মতো চরে বেড়াচ্ছিলো, পৃথার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করছিল সেই অপার্থিব দৃশ্যের সামনে স্থাণু হয়ে রয়েছিলো সে ততোক্ষণ, যতোক্ষণ না দিনমণি অস্তাচলে যান বৃদ্ধা আয়ি তাকে বারবার নিচে যেতে ডাকছিলো, পলা বা রন্তার এই ভবনে প্রবেশ নেই, অবতরণের সময় সোপাণাবলী ঠিকভাবে না দেখতে পেয়ে যদি পৃথা পড়ে যায়, আহত হয়, আয়ি সে বিষয়ে উদবিগ্ন হচ্ছিলেন সদ্যোনির্মিত গৃহ,  কোথাও কোনও সমস্যা আছে কি না তাও তো জানা নেই!
তারপর থেকে প্রত্যহ অপরাহ্নে সে এই ভবনে চলে আসে
একা একা ঘুরে বেড়ায় প্রতিটি কক্ষে, কোথাও কিছু নির্মাণ বা সংযোজন করতে হবে কি না লক্ষ্য করে, কিন্তু এসবের থেকেও সে আকর্ষণ বোধ করে ছাদ থেকে সূর্যাস্ত দেখবার ধীরে ধীরে বর্ণ পরিবর্তন হয় ধরণীর, মুহূর্তে মুহূর্তে অন্য অন্য রঙ, কোন চিত্রশিল্পী যে এমন নিপূণভাবে পলে পলে এ দৃশ্য অাঁকেন, তা ভেবে বিস্ময় হয় তার, বিস্ময় ছাপিয়ে ওঠে তার ক্ষুদ্র হৃদয়টিকে, তার সমস্ত সত্তাকে ভাসিয়ে সে বিস্ময় প্রবাহিত হয়! প্রথমবার ছাদের প্রাচীরের কাছে সে একটি শিলাপট্টসম প্রস্তরখণ্ড দেখেছিলো, নির্মাণের উদবৃত্ত প্রস্তর, সেটির উপর উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের প্রাকারে হাত রেখে সে সূর্যাস্ত দেখেছিলো পরে আর সেই খণ্ডটি পায়নি, হয়তো আয়িবৃদ্ধা সেটিকে সরিয়ে দিয়েছেন পৃথার নিরাপত্তার জন্য বিস্তৃত প্রান্তর, তৃণভূমি ও অরণ্যাভাসের পর যে দিগন্ত কুয়াশায় আবৃত, তারও পরে, কতো কতো দূরে অস্ত যান দিনদেব, তা সে দেখেছিলো প্রথমদিন সেই প্রস্তরটির ওপর দাঁড়িয়ে প্রস্তরটি নেই বলে তার দৃষ্টিসীমা সঙ্কুচিত হয়েছে, প্রান্তর পেরিয়ে দিগ্মণ্ডলের নিচে সূর্যকে অবসিত হতে আর সে দেখতে পায় না আকাশে ঈষৎ উপরে থাকা অবস্থায় তাঁকে বিদায় জানাতে হয়, আরও অল্পক্ষণ সে রক্তমেঘে দৃষ্টি ভাসিয়ে বসে থাকে, আয়ি ডাকেন, কয়েকবার, তারপর ছাদে উঠে আসেন, হাঁটুতে হাত বুলিয়ে বেদনা প্রশমন করেন, তারপর পৃথার পাশে বসে মথুরার গল্প শুরু করেন মথুরায় তিনি আর্যক শূরের গৃহে আশ্রিতা ছিলেন, পৃথার সঙ্গে কুন্তীভোজের গৃহে চলে এসেছেন মথুরা ছেড়ে আসার পর এ বালিকা কেমন যেন হয়ে গেছে, কতো উচ্ছ্বল ছিলো সে সেখানে, এখানে কথা প্রায় বলেইনা, সর্বক্ষণ কি যেন ভাবে, মনের ভেতরে কোন দুঃখ কি চাপা আছে তার? আর্যক শূরের গৃহ এই গৃহের তুলনায় সাধারণ, সেখানে প্রাচুর্য কম ছিলো, কিন্তু খোলামেলা পরিবেশ ছিলো, পরিবারটিও ছিলো বড়ো, পরিবারের মধ্যেই কথা বলবার খেলবার হাস্যরহস্য করবার অনেক লোক, সর্বদা হইহই হট্টগোল লেগেই আছে, সে এক গ্রাম্য সরস আন্তরিক পরিবেশ ছিলো এই গৃহে জোরে শব্দ করেনা কেউ রাজকার্য যে প্রশস্ত কক্ষে নির্বাহ হয়, তার পাশে আরো দুটি বৃহৎ কক্ষ, রাজ্য ও কার্য সম্বন্ধিত মানুষরা,  শাসনপ্রনালীর মানুষরা তথায় আসা যাওয়া করেন, সমস্তই নিয়মনিগড়বদ্ধ, সংযত ও প্রথানুগ রাজকার্যে কখনোই কারও কোন উচ্চস্বর হয়না এমন নয়, বিরল কোন কোন সময়ে উত্তপ্ত তর্কবিতর্কও হয় কিন্তু তাতে রাজনীতি আছে, অন্তর নেই, মস্তিষ্ক আছে, হৃদয় নেই এই নরপতির আশ্রয়ে তাঁরই প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে, তা অমন বালিকাবয়সে পৃথাই বা কেমন করে তা সহ্য করবে! আর্যক শূরের গৃহের অমন ফুল্লকুসুমিত কন্যাটি কুন্তীরাজের গৃহে এসে কেমন যেন শুকিয়ে গেছে, অবশ্য বাড়ের বয়েস তার, বাড়ের সময় কাউকে কাউকে একটু শুকনো লাগে আয়ি সময় পেলেই পৃথার সঙ্গে দুটো গল্প জুড়ে বসেন, তাকে কথা বলানোর চেষ্টা করেন, তার সমস্ত খেয়াল রাখেন বালিকার সময় হয়ে আসছে নারীত্বের উপকণ্ঠে পৌঁছানোর, আয়ি সেই সময়টির জন্য অপেক্ষায় আছেন, পৃথার সতেজ সুকুমার লাবণ্যময় মুখপানে চেয়ে তাঁর বুক কেঁপে ওঠে, পৃথা যেন ভালো থাকে হে ঈশ্বর, আর তো তার কেউ নেই!



*            *            *             *            *            *                   *



জন্মাবধি সে মাতাকে দেখেছিল, বিপুলস্তনী
খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে তার, মাতার স্তনে হাত রেখে ঘুমোতে তার ভালো লাগতো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে শব্দ শুনতে পেত, যেন দুজন মানুষ, খুব কষ্ট পাচ্ছে যেন, কিসের যেন আর্তি, বাক্য অর্ধস্ফূট তাদের, প্রায়ান্ধকারে দুটি মানুষ পরস্পরের মধ্যে কি যেন খুঁজছে মাতার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে সে বিস্মিত হতো, পিতার কণ্ঠস্বর তারপর কণ্ঠস্বর ঠিক নয় তা, কণ্ঠস্বরের মতো, তবু তা চেনা যায় তার অভিমান হতো গাঢ় অভিমান

 বসু তখন ছোটো
অত্যন্ত অধিক ছোটো নয়, বর্ষকালের সামান্য অতিরিক্ত দূরত্ব তাদের বয়সের বসু জন্মকাল থেকেই অতি অশান্ত শুধুমাত্র পৃথার কাছেই সে শান্ত থাকতো তাদের খেলাধুলা সব একসাথেই, একই ক্রীড়া তাদের পছন্দের পৃথা নব নব ক্রীড়ামোদ উদ্ভাবন করতো, বসু প্রচুর পুলকিত উল্লম্ফনে তাতে যোগ দিতো সেই মাতাপিতা, সেই বসুকে ছেড়ে আজ তাকে আসতে হয়েছে এই এক নৃপতির গৃহে, আজ ইনিই তার পিতা, এই গৃহে তার কোন মাতা নেই অাঃ কতো দূরে সেই মথুরানগরী, নগরীর উপকণ্ঠে তাদের সেই পল্লী, নিকটে হ্রদ ও বনাঞ্চল, বনাঞ্চলের সংলগ্ন বিস্তীর্ণ ভূভাগ, যেখানে গাভীগুলি শরতের মেঘের মতো চরে বেড়ায়, যেখানে বসুর সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা হতো, বজ্রাহত পিপ্পলী বৃক্ষটিকে একবার স্পর্শ করে কে আগে এই হ্রদের সমীপবর্তী শিশংপা বৃক্ষমূলে ফিরে আসতে পারে প্রতিবারই সে বসুকে জিতিয়ে দিতো, ওই বজ্রাহত পিপ্পলী বৃক্ষটির পরেই অরণ্য, অন্যবিধ হিংস্র শ্বাপদ আচম্বিতে এসে পড়তেই পারে, কিছু না হোক, বন্য কুক্কুর ও তরক্ষুদল তো রয়েছেই পিতা আর্যক শূর তাকেই বলে রেখেছিলেন, খেলাচ্ছলে বসু যেন অরণ্যের খুব কাছে চলে না যায়, পৃথা যেন তা লক্ষ্য রাখে বসু পিতার খুব আদরের বসু পৃথারও খুব আদরের তার স্বেদপরিপ্লুত গণ্ড অঞ্চলপ্রান্তে মার্জনা করতে গেলে সে অধৈর্য হয়ে ওঠে, তা দেখে পৃথার বুক ভরে হাসি উছলে উঠতে থাকে, ভাইয়ের আরক্তিম গণ্ডে সে বার বার চুম্বন করে, বসু নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গাল মোছে, তারপর দুইভাইবোন একত্রে হেসে ওঠে হাসি থামেই না তাদের হাসতে হাসতে তারা হাত ধরাধরি করে গৃহের দিকে অগ্রসর হয়, হাঁটতে চলতে দৌড়োতে দৌড়োতে, ধূলিধূসর অঙ্গ এবং পোশাকের জন্য মাতা কেমন ভঙ্গিতে ভর্ৎসনা করবেন, বসু সেই অভিনয় করতে করতে চলে, পৃথার আবারও ইচ্ছা হয় ভাইয়ের আরক্তিম মুখমণ্ডলে চুম্বন করতে...

জন্মাবধি বিপুলস্তনী মাতাকে দেখে তার বিশেষ কিছু মনে হয়নি, ইদানীং তার স্তনচেতনা গড়ে উঠছে
যেকোনও নারীর এবং পুরুষের বুক সে অপাঙ্গে যত্নপূর্বক লক্ষ্য করে বিভিন্ন নারীর স্তনের পৃথক পৃথক গঠন, প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র সেই বাল্যকালে, মাতা বসুকে স্তন্যদান করবার সময় পৃথা মাতার অন্য স্তনটিতে মুখ দিতে চাইতো, সে বড়ো হয়ে গেছে বলে মাতা তাকে ভর্ৎসনা করলে সে অন্য স্তনটি হাতে ধরে থাকতে চাইতো, কি এক নিশ্চিন্ততা, কি এক অধিকারবোধ ছিলো তাতে তাদের পল্লীতে দ্বিপ্রাহরিক অবসরে মাতা যখন স্বল্প সময় বিশ্রাম করতেন পৃথাকে প্রহরী রেখে, উর্দ্ধ্বাঙ্গে বসন রাখতেন না তিনি, এমনিতেই কঞ্চুলিকা ব্যবহার করতেনই না মাতা তার পল্লীর নারীদের মধ্যে কঞ্চুলিকা ব্যবহার করতে খুব কম যুবতীকেই দেখেছে পৃথা যমুনায় স্নানকালে যুবতী, প্রায় যুবতী, তরুণী ও কিশোরীযুথের উন্মুক্ত বক্ষে গাত্রমার্জনা মনে পড়ে তার কতো রকম স্তনশোভা, বৈচিত্র্যই বা কতো! যমুনায় ঘাটের সোপাণে কঞ্চুলিকা খুলে রেখেছিল বৃণুগোপের দয়িতা পিঙ্গলাক্ষী, বাতাসে উড়ে তা কখন যমুনাজলে পড়ে, যখন তারা দেখতে পায় তখন তা বহুদূর স্রোতে, পিঙ্গলা সাঁতরে তা উদ্ধার করতে চেয়েছিলো, অন্যেরা তাকে ধরে রাখে, যমুনার কোন কোন স্থানে ঘূর্ণি আছে বলে জ্যেষ্ঠরা বলেন কঞ্চুলিকাবিহনে সে নাকি অস্বস্তিবোধ করে, কন্যাকালে এমনকি পিতার সন্মুখেও নির্গত হতো না, হায় তার শ্বশ্রূমাতা কি বলবেন দেবদেবই জানেন! সেই অপার ভর্ৎসনাময়ী ভর্তৃখাদিকা রমণী পিঙ্গলাকে দুইটি অক্ষি পেতে দেখতে পারেন না, সদাসর্বদা নিগ্রহ করার কোন না কোন উপায় অন্বেষণ করেন সিক্তবস্ত্রের ওপর দূকুল জড়াতে জড়াতে অশ্রুপরিপ্লুত পিঙ্গলার এমত ভাষ্য, শুনে বালিকা পৃথা হেসে ফেলায় অকস্মাৎ ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছিলো পিঙ্গলা, হাসি পাচ্ছে, অয়ি পৃথে? হাসো হাসো, দেবদেব শঙ্কর যখন যখন তোমার বক্ষে যুগ্ম স্বর্ণকলস স্থাপন করবেন, তখন বুঝবি, কি জ্বালা! অন্য বালিকারা দেহবল্লরী হিল্লোলিত করে আরও হেসে উঠেছিলো, পৃথা হাস্য সংযত করেছিলো

জ্বালা? জ্বালা কেন হবে? নারীর বক্ষে স্তন হবে, এ তো স্বাভাবিক
এবং তা কোমল অঙ্গ, অস্থিহীন, তাই লোল হবে, বস্ত্রাচ্ছাদনে থাকবে, এতে জ্বালা কোথায়? অবশ্য কোন কোন বর্ষীয়ান পুরুষের বক্ষও লোল হয়, কিন্তু তা স্তন নয়, পৃথা জানে কটিদেশের নিচে পুরুষেরও তো লোল অঙ্গ থাকে, দৌড়োদৌড়ি করতে অসুবিধা হয় বলে তা দৃঢ়বদ্ধ করতে হয়, বাল্যকালে বসুকে অস্ত্রশিক্ষা দেবার সময় পিতা আর্যক শূর স্বহস্তে সেই বস্ত্র পরিধান করতে শিখিয়ে দিতেন, পৃথার মনে আছে পুরুষদের তো সকলকেই সে বন্ধন মেনে নিতে হয় বরং নারীর, সবার স্তন লোল হয়না, কারও কারও দৃঢ়োন্নতও হয়, পৃথা দেখেছে সন্তানকে স্তন্যদান করার জন্য নারীর বক্ষে স্তন দেন ঈশ্বর, শুধু মনুষ্যে নয়, সব প্রাণীরই তো তাই! জ্বালা কেন বললো পিঙ্গলা, পৃথা বোঝেনি অপর এক অগ্রজাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো সে, তাতে সে রহস্য করে বলেছিলো, অয়ি পৃথে, যাহা জ্বালা, তাহাই সুখ এই যে কোমল অঙ্গ আমাদের, তা যতোক্ষণ না পুরুষের বক্ষপীড়িত হয়, তখন জ্বালা, পীড়িত হলে সুখ, কিন্তু তা ক্ষণমাত্র, আর সেই ক্ষণমাত্র নিয়েই রোমন্থন করতে হয় ততোক্ষণ অব্দি, যতোক্ষণ না পরবর্তী পীড়ার অবকাশ ঘটে অয়ি পৃথে, একে বলে যৌবনবেদনা  বুঝবি, বুঝবি, তোর হোক, বুঝবি
  অপর এক অগ্রজা মুখ নেড়ে বলেছিলো, যৌবনবেদনা না আরো কিছু! পিঙ্গলার বক্ষোভার দেখেছিস তো, একএকটি তালফলসদৃশ
হাঁটতে চলতে বড্ডো বেশি দোলে, দৃঢ়বন্ধনে রাখতে হয় সেকারণেই বেচারির কষ্ট তায় অমন শ্বশ্রূমাতা তার পতিটির তো কথাই নেই...

   যৌবনবেদনা? সে কেমন বেদনা? ভার? জ্বালা? জ্বালাই সুখ? পীড়িত হলে সুখ? এ কেমন কথা? পৃথা বোঝেনি


   দেবদেব শঙ্কর জাগিয়ে দেন নারীর বক্ষের বর্তিকাযুগ্ম? নাকি রতিপতি মদন?  যুগ্ম স্বর্ণকলস? পৃথা টের পায়, তার বক্ষ জেগেছে, অঙ্কুরিত হয়েছে
সারা শরীরেই অন্যরকম অনুভূতি পেতে শুরু করেছে সে কয়েকদিন হলো উরুর পশ্চাদাংশ কেমন টানটান লাগে, কাষ্ঠাসনে বেশ চেপে বসতে পারলে সুখবোধ হয় নিতম্বের ঊর্ধ্বভাগের কটিদেশে, পশ্চাতে দুই পাশের দিকে, কেমন অলস অনুভূতি হয় ইদানীং অন্য কেউ ভ্রমক্রমে স্পর্শ করলে শিহরণ জাগে, শরীর আলোড়িত হয় পলা একদিন ছুঁয়ে দিয়েছিলো পলা এবং রন্তা এই দুইজন এই গৃহে তার সহচরী কিঙ্করী এবং প্রতিহারিণীও বটে পলা এক নিকষকৃষ্ণ তরুণী, এই রাজ্য তথা নগরী প্রতিষ্ঠার সময় সংলগ্ন অরণ্য উচ্ছেদ হয়েছিলো, অরণ্যবাসীরা প্রতিরোধ করেছিলো, সেই অরণ্যবাসিনী এক কন্যা সে, তার রক্তের সম্পর্কের মানুষেরা কেউ মৃত, কেউ বিতাড়িত, কেউ শস্ত্রচর্চা করে এই নৃপতির অধীনেই কর্মরত, কেউ অন্য কোথাও গিয়ে হয়তো এই নৃপতির উচ্ছেদের জন্য তপস্যা করছে পলাকে নৃপতি স্বয়ং আশ্রয় দেন সে পৃথার সহচরী অনেকদিন ধরেই, ইদানীং তার চোখের ভাষা অন্যরকম, স্পর্শ অন্যরকম প্রায়ই সে আর্যার হস্তপদ সংবাহন করে দিতে চায় কিম্বা আর্যার কেশপাশ সংবদ্ধ করতে অনুমতি চায় একদিন ক্লান্ত শরীরে পৃথা তাকে সংবাহনের অনুমতি দেয় তার স্পর্শ প্রথমে সুখকর ছিলো, অল্প তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো পৃথার, অসস্মাৎ জড়িমা ভেঙে গিয়ে পলার সম্পূর্ণ অন্যজাতীয় সংবাহন তার কটিদেশের দুইপ্রান্তে অনুভব করে উঠে বসে এবং পলাকে বিরত করে সর্বাঙ্গে শিহরণ, অস্থিসন্ধিগুলিতে যেন মোড়ামুড়ি করলে ভালো হয়, রক্তস্রোত উতরোল, যেমনটি আগে কখনো ঘটেনি নিজের শরীর অচেনা লাগছিলো পৃথার, বিস্ময় ও অস্বস্তির মধ্যে বিস্ময়ের ভাগই বেশি ছিলো তারপর থেকে সে এমনকি কবরীবন্ধনের জন্যও পলাকে অনুমতি দেয়না

বক্ষে অন্যরকমের অনুভূতি প্রথম বোঝে সে বস্ত্রের কারণে
গবাক্ষপার্শ্বে দাঁড়িয়ে অশ্বনদীর দিকে তাকিয়ে ছিলো সে, নদীর পরপারে উদ্যান যা এমনই শ্যামঘন যে অরণ্যের ভ্রমোৎপাদক, বায়ু উন্মাদের ন্যায় বইছিলো সেই অপরাহ্নে, একটি নীল চীনাংশুকের উত্তরীয় তার উত্তমাঙ্গে বিজড়িত, বারবার সেটি বাত্যায় আন্দোলিত হচ্ছিলো এবং স্থানচ্যুত হতে হতে স্তনবৃন্তে ঘর্ষিত হচ্ছিল
মধুর হিমস্পর্শী বায়ুর কারণে শরীরে কণ্টকোদগম হচ্ছিলো আগে থেকেই, তাতে বারবার স্তনবৃন্তে বস্ত্র ঘষা খাওয়া, শিহরিত হচ্ছিলো সে বারবার
একাধিকবার এমন হবার পর বিস্মিত হয় পৃথা, আগে কখনও তো এমন হয়নি, এখন এমন কেন হচ্ছে? দর্পণের সামনে গিয়ে সে বুঝতে পারে তার বক্ষ আর সমতল নেই, কুঁড়ির আভাস বিস্ময়, বিস্ময়! এই অঙ্গ যে বিশেষ, এ পৃথক অঙ্গ, এবং এ অঙ্গ তার শরীরে, এ যেন এক অনৈসর্গিক অনুভূতি! দেবাদিদেব স্বয়ম্ভু কখন স্থাপন করলেন? স্থাপন করার সময় তিনি পৃথাকে স্পর্শ করেছিলেন? তার বক্ষ? স্বপ্নের মধ্যে কি? ঘুমঘোরে? সে অবশ্য স্বপ্নে দেখেছে এক জটাজুটাবলম্বী উজ্জ্বল পুরুষকে, সে তো এমনি এমনি দেখে বিস্ময় মেশানো সম্ভ্রম উৎপাদন হয়েছিল, আর কিছু মনে নেই স্বপ্নরা মনে থাকে না উনিই কি যোগীরাজ শঙ্কর? যে স্বপ্ন তার মনে নেই, সেই স্বপ্নে কি তিনি এসেছিলেন, হাত রেখেছিলেন পৃথার বক্ষে? জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তার সদ্যোস্ফূট স্তন? লজ্জাবেশ বোধ করে পৃথা, স্নিগ্ধচন্দ্রবর্ণের কপোল তার অরুণবর্ণ হয়ে ওঠে অলস দ্বিপ্রহরে তার কক্ষে পরিচারিকারা কেউ নেই, পূর্ণাবয়ব মুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে বক্ষোবাস উন্মোচন করে সে দক্ষিণমুখী গবাক্ষপথে দেবদিনমণির কিরণ গৃহাভ্যন্তরের মর্মরপ্রস্তর থেকে আভাসিত হচ্ছে, পৃথা নিজের বক্ষের সদ্যোমুকুলিত কমলকলিকাদ্বয়ের দিকে অপলকে চেয়ে থাকে কি যেন উল্লাস, অপার্থিব যেন এক পুলকানুভূতি আবার কিসের যেন বিষাদও কি যেন চলে যাচ্ছে এখনো তার রেশটুকু রয়েছে, কিন্তু দিনের আলোটুকু এই ধরার বুক থেকে যেমন অল্পে অল্পে মুছে যায় তেমনই তার জীবন থেকে কেউ যেন বিদায় গ্রহণ করছে

  পৃথার জীবন থেকে বিদায় গ্রহণ করছে বাল্যকাল
আর সে ফিরবেনা থেকে যাবে শুধু স্মৃতিতে



                                                                                             চলবে...

No comments:

Post a Comment