কবিতা - রঙ্গন রায়







থার্ডবেল

যে ভীষণ উত্তেজনা বুক ঢিপঢিপের কারণ আমরা তার পেছনে বসে আছি হাঁটুমুড়ে।প্রেক্ষাগৃহে দ্বিতীয় বেল পড়ে গিয়েছে।এরপর পর্দা খুলবে আর অডিটোরিয়াম জুড়ে যে দুর্ধর্ষ দর্শকের দৃষ্টি তা প্রথমেই দর্শন করে নেবে আমাদের। সমস্ত অন্ধকারের মধ্যে যেভাবে মাঝেমাঝে জোনাকির গন্ধ ছুটে আসে - আমরা রস্টামে বসে ঘ্রাণ নিচ্ছি পরস্পরের ঘাম। মেয়েরা পুরুষালি গন্ধে- ছেলেরা মেয়েলি - কখনো দুয়ে মিলে জটিল আবর্তের মাধ্যমে অপেক্ষা, সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে থার্ড বেল। স্মোকলাইট জ্বলে উঠলো। নমস্কার। পর্দা খুলে যাচ্ছে। এইবার দৃশ্যমান হবে থার্ডফর্ম।



এবং জোনাকি

ছেলেটি জোনাকি টিপছে আর আলো ছড়াচ্ছে।  এই দৃশ্যকে বন্দী করার জন্য মোজার ভেতর চকচকে জোনাকি ভরে ফেললাম। বাড়ি নিয়ে যাবো। তারপর অনেক আলো হবে। ছেলেটি জোনাকির মত মিটমিট করে চেয়ে আমাকে দেখলো। কিছু কি ভাবলো? বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি জঙ্গলে পথ হারিয়েছি। অন্ধকার। চাঁদ নিভে গেছে। আমি হাসলাম - আমার নিজস্ব আলো রয়েছে হে অন্ধকার অরন্য --- আমি এখন নিজেই নক্ষত্র। মোজার ভেতর থেকে জোনাকি বের করে টিপলাম , একফোঁটা অন্ধকার পিছলে নামলো। আমি পাগলের মত মোজা হাতড়াতে শুরু করলাম --- কিন্তু মোজার সমস্ত জোনাকি ধীরে ধীরে রাত হয়ে গেছে।  এরপর আমি বাড়ি ফিরবো কি করে? সেই ছেলেটিই বা কোথায়? নদীর ভেতর থেকে জলের ঠোঁট উঠে এলো। শীত লাগলো। গায়ে সোয়েটার পায়ে মোজা থাকা সত্ত্বেও খুব শীত লাগলো। সেই ছেলেটি হয়তো এতক্ষণে ব্যক্তিগত বড়দিনের ছুটি কাটাচ্ছে জোনাকিদের সাথে



রাস্তা বিষয়ক

আমি একজন ইতর, যে রাস্তায় থুতু ফেলি আর তার উপরেই পা। যেদিন জ্যোতি বসু রাস্তায় হেঁটে এলেন, আমি তাঁর পা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছি লাল রং। তারপর একেএকে অসংখ্য মানুষ। চেটে চেটে যে পাগল তুলে নিচ্ছে হর্লিক্সের গুড়ো ... পুষ্টিকর মানুষেরা খুলে যাচ্ছে রাস্তার টাইমকল...
আমি এমন একটা রাস্তায় জন্মেছি যেখানে ঋত্বিক ঘটক আগেই হেঁটে গেছেন। ফিরে আসছি খোয়া ওঠা -ছাল চামড়া ওঠা রাস্তার ভালোবাসায় ... হাঁটুর নুনছাল ছড়ে ঝরে পড়ছে লাল রং ... অসহ্য পৃথিবীতে টাল খেলে পড়ে থাকতে হবে রাস্তায় ... বেঁচে থাকলে হাত বাড়াতেন সাফদার হাশমী, আর 'হাল্লাবোল' চিৎকার করতে করতে তাঁর কান দিয়ে বেড়িয়ে আসতো ঘিলু্‍ ... আমি ফুটপাতে শুয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মনে করি, যার ফুটপাত বদল হয়ে যায়, আমি বদলাতে পারিনা ...
রাস্তা একটি সর্পিল গতি ... আমি জ্যামিতি থেকে খুলে নিলাম সরলরেখা আর তার উপর লাফালাফি করে বক্ররেখা ... অংককে এভাবে ভাঙচুর করলেই একদিন রাস্তা খুলে যাবে, আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ থেকে ছিটকে বের হবে ... ' এই পথ যদিনা'...



"it's elementary my dear watson"

প্রচন্ড আক্রোশে সাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট করতে ইচ্ছে করছে। আমি একবার চাঁদের দিকে তাকাচ্ছি , একবার শ্যামল সিংহ...তারপর জ্যোৎস্না অনুবাদের চেষ্টা করছি, যদি টাকা পাওয়া যায় - আমার পা থেকে জুতো খুলে নিয়ে যাচ্ছে মন্দির ... আমার শরীর থেকে শরীর খুলে নিচ্ছে ঈশ্বর;  তারপর ফুটপাতে নেমে এলাম। ভিখিরীর সামনে খুচরো কয়েনের পরিবর্তে ঢেলে দিলাম একমুঠো কবিতা। ভিখিরী বলল, 'কিরে চাঁদ দেখবি? ঐ দেখ শুন্য হয়ে যাচ্ছে সমস্ত রাজনীতি ... খিদে পেয়েছে? বসে পড় আমার পাশে, চোখের জলের অনুবাদ শিখলেই একদিন খেতে পারবি আর চাঁদ খেলে জ্যোৎস্না বের হয়ে আসবে লিঙ্গ থেকে...'  তারপর আমি তর্জমা করতে করতে, ফুটপাত করতে করতে, আকাশের তারা গোনা শুরু করলাম।




শিশু নিকেতন

রিহার্সালে গেলাম। বললাম, আমি তো কবিতা লিখি; নাটক আমার ক্ষেত্র নয়। ওরা দয়াদাক্ষিণ্য করে দিলো। কবি সম্মেলনে গেলাম। বললাম , আমি তো নাটক করি;  কবিতা আমার ক্ষেত্র নয়। ওরা দয়া দাক্ষিণ্য করে দিলো। দয়া দাক্ষিণ্য নিয়েই বেঁচে আছি। এভাবেই একটা কবিতা লিখে ফেললাম, ওরা বললো নাট্যকাব্য লিখতে। আমি নাট্যকাব্য লিখতে জানিনা। ওরা বললো কবিতায় নাটকীয়তা এনোনা। আমি সেটাও পারলামনা। নিজের নাম নিয়ে খেলতে খেলতে শিশুর নামকরণ শুরু করলাম। এরপর থেকে একঝলক বাতাস এসে নাকে ধাক্কা মারে আর শিশু শিশু গন্ধ পাই। আমি আবার শৈশব থেকে শুরু করলাম ...




ট্রেজার আইল্যান্ড

জাহাজের মাস্তুলে একটা পাখি বসে আছে , জাহাজ বন্দর ছাড়ার সময় থেকেই... নাবিকের হাতে কম্পাস - ক্যাপ্টেনের হাতে সেক্সট্যান্ট (যন্ত্র) - ল্যাটিচুড লঙ্গিটিউড মাপছেন , ম্যাপ ঘাটছেন . . . গ্লেসিয়ারের পর গ্লেসিয়ার পার হয়ে চলে যাচ্ছে। ছোটবেলায় ট্রেজার আইল্যান্ডের গল্প পড়েছি . . . রুপকথার অচিন পুরও - সাত সমুদ্র তেরো নদীর পর, পাখিটি মাস্তুল থেকে একদৃষ্টে দেখছে অথৈ নীল জল - ক্যাপ্টেনের কপালে রাজ্যের চিন্তা ভাঁজ ফেলেছে , তবুও ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আর কতদূর?" নাবিক আঙ্গুল তুলে মাস্তুলে দেখালেন - জাহাজের মাস্তুলে একটা পাখি বসে আছে, জাহাজ বন্দর ছাড়ার সময় থেকেই . . . আর তর সইলো না - গুগল খুলে ফেললাম; ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ডট ট্রেজার আইল্যান্ড ডটকম, সার্চ করতেই পাখিটি উড়ে গেলো . . . যে এতক্ষণ মাস্তুলে বসে ছিল - জাহাজ বন্দর ছাড়ার সময় থেকেই



2 comments:

  1. প্রত্যেকটার প্রথমদিকের কথাগুলো দেখ, আর শেষে কোথায় আসছে। অসম্ভব প্রতিশ্রুতি জাস্ট কোথাও গিয়ে নেই হয়ে যাচ্ছে। বেশ লেখা।

    ReplyDelete